লামিয়া এখন শিশু থেকে কিশোরী। কিন্তু ১০ বছর বাবার দেখা পাননি। বাবাকে খুঁজে বের করার দাবিতে বহুবার রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন সে। আজ শনিবারও একই অবস্থা। বাবার ছবি হাতে নিয়ে কাঁদছিলেন লামিয়া ইসলাম নামের এক কিশোরী। অন্য বন্ধুদের মতো সেও বাবার হাত ধরে হাঁটতে চায়, স্কুলে যেতে চায়। কিন্তু বাবা কোথায়, বাবাকে ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ করেন তিনি।
লামিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে, 'আমার বাবার নাম কাউছার। ১০ বছর হয়ে গেল, আমি আমার বাবাকে খুঁজছি। খুব ইচ্ছে করে, বাবার হাত ধরে হাঁটব। আমার বন্ধুরা তাদের বাবার সাথে স্কুলে যায়। আমিও বাবার সাথে স্কুলে যেতে চাই। আমি কেন পারব না? আমি কি বাবার সাথে স্কুলে যেতে পারি না?'লামিয়ার মতো গুমের শিকার। সোহেলের ছোট মেয়ে সাফা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আর কত দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবাকে ফেরত চাইব? বাবাকে ছাড়া আমার একদম ভালো লাগে না। আমার একটাই দাবি, বাবাকে ফিরিয়ে দাও। আমি আর কিছু চাই না। আমি শুধু আমার বাবাকে চাই।
শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে নিখোঁজদের স্বজনদের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন মায়ার ডাক। শিশু সাফা বা লামিয়া নয়, তাদের মতো নিখোঁজ পরিবারের আরও ৩৫ জন সদস্য অংশ নেন। অন্তর্ধানের শিকারদের জন্য আন্তর্জাতিক স্মরণ সপ্তাহ উপলক্ষে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
বাবা-মা নিখোঁজ সন্তানের ছবি ধরে আছেন, ভাইরা নিখোঁজ ভাইয়ের ছবি ধারণ করছেন, অবিলম্বে তাদের স্বজনদের মুক্তি দিতে হবে।
তবে রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার কর্মীসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা মায়ের সমাবেশে যোগ দেন। তাদের মতে, ২০০৯ সালের পর বাংলাদেশে গুমের ঘটনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এ সময় সাধারণ মানুষ, বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীরা গুমের শিকার হয়েছেন, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা শনাক্ত হওয়ার পরেও অনেকে বেহিসেব থেকে যায়।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান নিখোঁজের জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'তবে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না। আমি বারবার বলেছি, গুমের জন্য যারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করুন। কিন্তু বছরের পর বছর দাবি সত্ত্বেও কোনো তদন্ত কমিশন করা হয়নি।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, এই সরকার এখন বিপদে পড়েছে। সরকারের প্রতি দেশের জনগণের কোনো সমর্থন নেই। বিদেশেও তাদের সব সমর্থন চলে গেছে। এই 14-15 বছরে গুম, খুন, গুম, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার-নির্যাতন সহ্য করেও টিকতে পারছে না ব্যর্থ সরকার।
স্বাধীনতা আপনা আপনি আসে না মন্তব্য করে বিখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, 'আমিও নিখোঁজ ছিলাম। পরে আমাকে বলা হয় আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে গ্রেফতারের নিয়ম আছে। তাদের কেউই গৃহীত হয়নি। রাতের আঁধারে এসে মাঝরাতে আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। আমার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। এটাই আমাদের বাংলাদেশ। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে। স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। অত্যাচারী স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করে না।'
মাদারস কলের সমন্বয়ক সানজিদা আক্তার বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে গুম ও খুনের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এরপর সব বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। গুমের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হবে।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন নারী নেত্রী ফরিদা আক্তার, বিএনপি নেত্রী তাবিথ আউয়াল, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান, মায়ের ডাক মঞ্জুর হোসেন ঈসা, আফরোজা ইসলাম প্রমুখ।
0 Comments